অভিমানের দেয়াল
পর্ব ১: প্রথম দেখা, প্রথম অনুভূতি
শরতের শেষ বিকেল। শহরের রাস্তায় তখন ধুলোবালি উড়ছে। বাসের হর্ন, সিএনজির শব্দ, পথচারীর হাঁটাহাঁটি—সব মিলিয়ে যেন শহরটা ক্লান্ত। কিন্তু সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসটা অদ্ভুত রকম শান্ত। গাছের পাতায় হালকা বাতাস বইছে। চারপাশের কোলাহলের বাইরে ক্যাম্পাসের নির্জনতা যেন নিজের আলাদা দুনিয়া তৈরি করেছে।
রাফি দাঁড়িয়ে আছে লাইব্রেরির সামনে। চোখে হালকা ক্লান্তি, কিন্তু ঠোঁটে একফোঁটা হাসি। গত তিন বছর ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই সে পড়ছে, কিন্তু আজকের দিনটা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে—সে তো জানে না। হাতে একটা পুরোনো বই, লেখকের নাম আধা মুছে গেছে। বইটা জমা দিতে লাইব্রেরিতে এসেছিল, কিন্তু কেন যেন ভেতরে যাওয়ার আগে সে দাঁড়িয়ে আছে, সিগন্যাল দিচ্ছে নিজের বুকের ভেতর ধুকপুকানি কমাতে।
ঠিক তখনই লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এল সে— মেয়ে। মেয়েটির চুলগুলো খোলা, লম্বা, রোদে ঝিলমিল করছে। সে হাঁটছে ধীর পায়ে, হাতে দুইটা বই। হালকা নীল রঙের সালোয়ার-কামিজ পরা। মুখে কোনো কৃত্রিম সাজ নেই, কিন্তু তাতেই তার রূপ যেন আরও স্পষ্ট। রাফির চোখ হঠাৎ থমকে গেল। সে কি কখনো এরকম কাউকে দেখেছে? হয়তো দেখেছে, কিন্তু এরকম অনুভূতি আগে কখনো হয়নি।
মেয়েটি রাফির দিকে তাকিয়ে হালকা একটা হাসি দিল।
—“আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ঢুকবেন না?”
রাফি একটু লজ্জা পেয়ে বলল,
—“হ্যা… হ্যা… ঢুকছি।”
তারপর সে ভেতরে ঢুকে গেল, কিন্তু মাথার ভেতর সেই মেয়েটির মুখটা ঘুরতে লাগল। বুকের ভেতর কেমন অদ্ভুত কাঁপুনি।
রাফির জীবন
রাফি গ্রামের ছেলে। ছোটবেলায় বাবা হারানোর পর মা-ই তাকে বড় করেছেন। ছোট্ট শহর থেকে ঢাকায় এসে পড়াশোনা করা তার জন্য সহজ ছিল না। ছাত্রাবাসে থাকত, টিউশন করত, আর পড়াশোনার খরচ জোগাত। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে এখন সে একটু অভ্যস্ত হয়ে গেছে শহরের জীবনে। কিন্তু তার ভেতরের মানুষটা এখনও সরল, একটু লাজুক, একটু স্বপ্নবিলাসী।
আজকের দিনটা তার কাছে আলাদা লাগছে। কেন জানি না। হয়তো কারণ সে জীবনে প্রথমবার কোনো অচেনা মেয়ের হাসি দেখে এতটা অস্থির হয়েছে।
রিতুর আগমন
মেয়েটির নাম রিতু। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। খুব বেশি বন্ধু নেই, বরং সে একা থাকতে পছন্দ করে। বই পড়তে ভালোবাসে, কবিতা লিখে, আর মাঝে মাঝে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার জীবনের গল্পও সহজ না। ছোটবেলায় বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছিল। মা তাকে নিয়ে বড় করেছেন। হয়তো এই কারণেই সে একটু গম্ভীর, কিন্তু তার ভেতরে একটা অদ্ভুত কোমলতা আছে।
রাফি জানে না যে এই মেয়েটির হাসির পেছনে কতটা অভিমান জমে আছে। সে শুধু জানে, সেই হাসি তার বুকের ভেতর আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে।
প্রথম আলাপ
দু’দিন পর, একই লাইব্রেরিতে আবার দেখা হলো। এবার রাফি সাহস করে এগিয়ে গেল।
—“আপনার নামটা কি জানতে পারি?”
রিতু প্রথমে অবাক হলো। তারপর হালকা হাসল।
—“রিতু।”
—“আমি রাফি।”
এরপর তারা বইয়ের বিষয়ে কিছু কথা বলল। খুব সাধারণ কথোপকথন, কিন্তু রাফির কাছে মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আলাপ।
এভাবেই ধীরে ধীরে কথা বলা শুরু হলো। কখনো ক্যান্টিনে দেখা, কখনো লাইব্রেরিতে। তাদের কথোপকথন বাড়তে লাগল, কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে রাফির মনে জন্ম নিল এক অদ্ভুত ভয়।
ভালো লাগার শুরু
রাফি বুঝতে পারল, সে রিতুর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। কিন্তু তার ভেতর একটা সংকোচ আছে। সে সাধারণ ছেলে, টিউশনের টাকায় পড়াশোনা করে। আর রিতু? তার আচার-আচরণে বোঝা যায়, সে হয়তো ভালো পরিবার থেকে এসেছে।
তবু ভালো লাগা তো থেমে থাকে না। রাফি প্রতিদিন রিতুর জন্য নতুন করে অপেক্ষা করতে লাগল। রিতুও হয়তো কিছুটা বুঝতে পারছিল, কিন্তু সে চুপ থাকত। তার চোখে এক ধরনের দুঃখ লুকানো থাকত, যা রাফি লক্ষ্য করত।
রিতুর গোপন দুঃখ
একদিন ক্যান্টিনে বসে রিতু হঠাৎ বলে উঠল,
—“তুমি কি কখনো কাউকে হারিয়েছ?”
রাফি অবাক হয়ে তাকাল।
—“হ্যা… বাবা মারা গিয়েছিলেন আমি ছোট থাকতে।”
রিতু চুপ হয়ে গেল। তারপর ধীরে বলল,
—“আমার বাবা-মা আলাদা হয়ে গেছেন। আমি তখন মাত্র দশ বছরের। তখন থেকেই আমি শিখেছি, মানুষের ভালোবাসা অনেক সময় অস্থায়ী।”
এই কথা শুনে রাফির বুকটা কেমন যেন মোচড় দিল। সে বুঝতে পারল, রিতুর হাসির আড়ালে গভীর অভিমান লুকানো আছে। সে কিছু বলল না, শুধু চুপচাপ তার দিকে তাকাল।
মনের কথা জমে ওঠা
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব গভীর হতে লাগল। রাফি রাতে টিউশন সেরে ক্লান্ত হয়ে ফেরার সময়ও রিতুর হাসি মনে করে হাসত। রিতু মাঝে মাঝে তাকে কবিতা শোনাত, আর সে মন দিয়ে শুনত।
একদিন বৃষ্টির বিকেলে, ক্যাম্পাস প্রায় ফাঁকা। দু’জনেই গাছতলায় বসে আছে। হালকা বৃষ্টি পড়ছে। রাফি হঠাৎ বলল,
—“রিতু… আমি কি তোমাকে কিছু বলতে পারি?”
রিতু তাকাল তার দিকে।
—“বল।”
রাফি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর ধীরে বলল,
—“আমি জানি না এটা বলা ঠিক কিনা… কিন্তু তোমাকে আমি খুব পছন্দ করি।”
রিতু চুপ হয়ে গেল। বৃষ্টির ফোঁটা তার চুলে লেগে আছে। কিছুক্ষণ পরে সে মৃদু হেসে বলল,
—“পছন্দ করাটা খারাপ কিছু না।”
এই উত্তর শুনে রাফির বুকের ভেতর আলো জ্বলে উঠল। সে জানত না রিতুর মনের ভেতর কি চলছে, কিন্তু তার চোখে যেন এক ঝলক মায়া দেখা গেল।
নতুন অধ্যায় শুরু
সেই দিনটা তাদের সম্পর্কের একটা মোড় ঘুরিয়ে দিল। তারা আরও কাছাকাছি হতে লাগল। একসঙ্গে পড়াশোনা করা, বই আলোচনা করা, ক্যান্টিনে চা খাওয়া—সবকিছুতে যেন অদ্ভুত এক আনন্দ।
রাফি অনুভব করছিল, জীবনে এই প্রথমবার সে সত্যিকার ভালোবাসা পাচ্ছে। কিন্তু সে এখনও বুঝতে পারছিল না, রিতুর ভেতরের ভয়টা কতটা গভীর।
অজানা ঝড়ের আগমন
যখন সবকিছু সুন্দরভাবে এগোচ্ছিল, তখনই জীবনের বাস্তবতা তাদের সম্পর্কের সামনে একটা কঠিন দেয়াল তৈরি করে দিল।
রাফির পরিবার থেকে ফোন এল। তার মায়ের অসুস্থতা বেড়ে গেছে। পড়াশোনার পাশাপাশি তাকে এখন আরও বেশি টিউশন করতে হবে। আর রিতুর পরিবারও তার সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে পেরে আপত্তি জানাল।
রিতুর মা বললেন,
—“তুমি এখনও ছোট। পড়াশোনা শেষ না করে এসব নিয়ে ভাবা উচিত না। আর ওই ছেলে… তার কি কোনো স্থায়ী কিছু আছে?”
এই কথাগুলো রিতুর মনে সন্দেহের বীজ বপন করল। সে রাফিকে ভালোবাসে, কিন্তু মায়ের কথাও অস্বীকার করতে পারল না।
পর্ব ১-এর সমাপ্তি
বৃষ্টির রাত। রিতু জানালার পাশে বসে আছে। হাতে রাফির দেওয়া চিঠি। তার চোখে জল। সে জানে, তার ভালোবাসা সত্যি, কিন্তু সমাজ আর পরিবার তাদের জন্য কতটা বাধা হয়ে দাঁড়াবে, সে জানে না।
অন্যদিকে রাফি হাসপাতালে মায়ের পাশে বসে আছে। তার চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মনে শুধু একটাই নাম—রিতু।
তাদের ভালোবাসা শুরু হয়েছে, কিন্তু সামনে যে ঝড় আসছে, তারা কেউ জানে না সেটা কতটা বড়।
(চলবে…)