অভিমানের দেয়াল - পর্ব ২

অভিমানের দেয়াল

পর্ব ২: দূরত্বের শুরু

বৃষ্টির রাতের পরের দিন সকাল। আকাশ মেঘলা, যেন প্রকৃতিও কারও মনের অস্থিরতার সাথে তাল মিলিয়েছে। রিতু ক্লাসে যায়নি। ঘরে বসেই জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। রাফির দেওয়া চিঠিটা তার টেবিলের ওপর রাখা। সে চিঠিটা বারবার পড়েছে গত রাতে। প্রতিটি শব্দে রাফির সরলতা আর ভালোবাসা ঝরে পড়েছে। কিন্তু তার মনের ভেতর এখনো দ্বিধা, ভয় আর চাপা কষ্ট।

রিতুর মা সকালে আবারও তাকে বুঝিয়ে বলেছেন, “মা, এখনো অনেক কিছু দেখার বাকি। তুমি এত ছোট, জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এত তাড়াতাড়ি নেওয়া উচিত না। আর ও ছেলে তো গরীব, টিউশনের টাকায় চলে, ভবিষ্যতে সে তোমাকে কীভাবে সুখ দেবে?” মায়ের কথাগুলো তার মনে কাঁটার মতো বিঁধেছে।

অন্যদিকে রাফির জীবনেও ঝড় বইছে। তার মায়ের অসুস্থতা বেড়েছে। ডাক্তার বলেছেন নিয়মিত চিকিৎসা আর বিশ্রাম দরকার। কিন্তু রাফির হাতে তেমন টাকা নেই। যতটা পারে সে টিউশন নিচ্ছে, রাতে ঘুমানোরও সময় নেই। এই অবস্থায় রিতুর সঙ্গে দেখা করার সময় বের করাও কঠিন হয়ে উঠেছে।


দূরত্বের প্রথম অনুভূতি

আগে প্রতিদিন অন্তত একবার হলেও রাফি আর রিতুর দেখা হতো। এখন সেই সময়টা যেন ক্রমেই কমে যাচ্ছে। ফোনে কথা হলেও আগের মতো উচ্ছ্বাস নেই।

রিতু মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়। “তুমি কি আমাকে সময় দেবে না? এত ব্যস্ত কেন?” সে একদিন মেসেজ করল।

রাফি উত্তর দিল, “আমি চেষ্টা করছি রিতু। কিন্তু মায়ের অবস্থা খুব খারাপ। টাকাও নেই। আমি চাচ্ছি তুমার সাথে সময় কাটাতে, কিন্তু এই মুহূর্তে আমি পারছি না।”

রিতুর মন খারাপ হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে রাফি সত্যিই সমস্যার মধ্যে আছে। কিন্তু তার ভেতরের অভিমানী মেয়েটা এই দূরত্ব মেনে নিতে পারছে না। তার মনে হয়, রাফি কি তাকে আর আগের মতো ভালোবাসে না? নাকি তার জীবনে অন্য কেউ এসেছে?


একটি অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎ

দু’সপ্তাহ পর একদিন ক্যাম্পাসে রাফি হঠাৎ রিতুকে দেখতে পেল। সে তখন বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছিল। রিতুকে দেখে সে এগিয়ে গেল। কিন্তু রিতু তখন যেন অন্যরকম। তার চোখে ক্লান্তি, ঠোঁটে জোর করে হাসি।

“কেমন আছো?” রাফি জিজ্ঞেস করল।

“ভালো।” সংক্ষিপ্ত উত্তর রিতুর।

“আমরা অনেকদিন একসাথে বসিনি। আজ বিকেলে সময় হবে?”

রিতু মাথা নেড়ে বলল, “দেখি।” তারপর সে হেঁটে চলে গেল।

রাফি হতাশ হলো। সে বুঝতে পারছে, তাদের মধ্যে অদৃশ্য একটা দেয়াল তৈরি হচ্ছে।


মায়ের হাসপাতাল

রাতে রাফি হাসপাতালের করিডরে বসে আছে। তার মা ঘুমাচ্ছেন, কিন্তু রাফির চোখে ঘুম নেই। হাসপাতালের দেয়ালে হালকা সাদা আলো, চারপাশে ওষুধের গন্ধ। সে চুপচাপ ফোনটা হাতে নিয়ে রিতুর মেসেজ দেখতে লাগল।

শেষবার রিতু মেসেজ করেছিল, “তুমি আমাকে আর সময় দাও না।”

রাফির বুকটা হঠাৎ কেঁপে উঠল। সে মেসেজ লিখল, “আমার অবস্থাটা তুমি বুঝতে চেষ্টা করো রিতু। আমি তোমাকে আগের মতোই ভালোবাসি।” কিন্তু পাঠানোর আগেই থেমে গেল। সে ভাবল, এই মুহূর্তে কথাগুলো হয়তো রিতুর কাছে অর্থহীন লাগবে।


রিতুর একাকিত্ব

এদিকে রিতু তার ঘরে বসে কাঁদছে। সে বুঝতে পারছে না, ভালোবাসা এত জটিল কেন? আগে রাফি প্রতিদিন তাকে ফোন করত, মেসেজ দিত। এখন কেন সে এত ব্যস্ত? সে কি সত্যিই রাফিকে হারাতে বসেছে?

রিতু নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে রাফি সমস্যায় আছে। কিন্তু তার শৈশবের অভিজ্ঞতা তাকে ভেতর থেকে নাড়া দেয়। সে ভাবে, “আমার বাবা-মা-ও তো বলেছিল সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হয়নি। হয়তো রাফিও একদিন হারিয়ে যাবে।”


একটি ফোনকল

রাত সাড়ে এগারোটা। রিতু ফোন করল রাফিকে। “তুমি কোথায়?”

রাফি বলল, “হাসপাতালে। মা ঘুমাচ্ছে।”

রিতুর কণ্ঠ কেঁপে উঠল, “তুমি কেন আমাকে কিছু বলো না? আমি কি তোমার মানুষ নই?”

রাফি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “রিতু, আমি চেয়েছিলাম তোমাকে এসব থেকে দূরে রাখতে। আমি চাই না তুমি কষ্ট পাও।”

রিতুর চোখে পানি এসে গেল। “কিন্তু আমি তো তোমার সাথে থাকতে চাই, কষ্ট ভাগ করতে চাই।”

রাফি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর মৃদু স্বরে বলল, “আমার হয়তো তোমার মতো কাউকে দরকারই ছিল।”


প্রতিজ্ঞা

রাতের এই কথোপকথনের পর রিতুর মনে নতুন শক্তি এল। সে সিদ্ধান্ত নিল, যাই হোক না কেন, সে রাফির পাশে থাকবে। সে চায় না তাদের ভালোবাসা ভুল বোঝাবুঝির কারণে ভেঙে যাক।

পরের দিন সকালে রিতু হাসপাতালে গেল। রাফি তাকে দেখে অবাক হলো। “তুমি এখানে কেন?”

“তুমি ভেবেছ আমি শুধু সুখের সময়েই থাকব? আমি তোমার সাথে আছি, রাফি।” রিতুর কণ্ঠে দৃঢ়তা।

রাফির চোখে পানি এসে গেল। সে রিতুর হাত ধরে বলল, “আমি কখনো তোমাকে হারাতে চাই না।”


অন্যদের চাপ

কিন্তু বাইরের পৃথিবী তাদের এই সম্পর্ক মেনে নিতে রাজি নয়। রিতুর মা আবারও তাকে বকেছেন। “তুমি এমন একজন ছেলেকে ভালোবেসেছ, যার নিজের ভবিষ্যৎই অনিশ্চিত। তুমি কি জানো ভবিষ্যতে কী হবে?”

রিতু চুপ করে গেছে। তার ভেতরের দ্বন্দ্ব আরও বাড়ছে। কিন্তু সে জানে, এই সম্পর্ক সত্যি।


মনের ঝড়

দিন যাচ্ছে, চাপ বাড়ছে। রাফি সমস্যায় ডুবে যাচ্ছে, রিতু পরিবার থেকে চাপ পাচ্ছে। তাদের সম্পর্কের ওপর অজানা ঝড় নেমে এসেছে।

কিন্তু এই ঝড়ের মধ্যেও তারা একে অপরকে আঁকড়ে ধরে আছে। তারা জানে না ভবিষ্যতে কী হবে, তবে তাদের চোখে এখনো স্বপ্ন আছে।


পর্ব ২-এর সমাপ্তি

বৃষ্টি নামছে শহরে। হাসপাতালের জানালার বাইরে বৃষ্টির শব্দ, আর ভিতরে নিস্তব্ধতা। রাফি আর রিতু চুপচাপ বসে আছে। তাদের চোখে ক্লান্তি, কিন্তু সেই ক্লান্তির মধ্যে এক অদ্ভুত ভালোবাসা। হয়তো এই ভালোবাসাই তাদেরকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু সামনে যে পথ, তা সহজ নয়।

(চলবে…)

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post