অভিমানের দেয়াল
পর্ব ৪: শেষ আলো
শীতের শেষ বিকেল। সূর্যের আলোটা যেন নরম কমলালেবুর খোসার মতো সোনালি। হাসপাতালের করিডরে বসে আছে রাফি। তার মুখে ক্লান্তি, চোখে ঘুম নেই। গত কয়েক মাস ধরে তার জীবন যেন কেবল হাসপাতাল, টিউশন আর দুশ্চিন্তার মধ্যে আটকে গেছে। মায়ের চিকিৎসার খরচ মেটাতে সে যা পারছে করছে, কিন্তু তবুও সবসময় মনে হচ্ছে কিছু একটা কম।
রিতু প্রতিদিন আসে। সকালবেলায় ক্লাস শেষে, বিকেলে কখনো কখনো কিছু ফল বা খাবার নিয়ে আসে। রাফির চোখে এই মেয়েটা শুধু প্রেমিকা নয়, তার জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে উঠেছে।
অস্থির রাতের গল্প
গত রাতে রাফির মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ডাক্তার এসে বলেছিলেন, “এখন খুব সাবধানে রাখতে হবে। ওষুধ আর রেস্ট ছাড়া উপায় নেই।”
রাফি তখন ফ্লোরে বসে মায়ের হাত ধরে কাঁদছিল। তার মনে হচ্ছিল, জীবন এত কঠিন কেন? একদিকে দারিদ্র্য, অন্যদিকে মায়ের অসুস্থতা। আরেকদিকে রিতুর পরিবার থেকে চাপ। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, “রিতু, তুমি যদি ওর সাথে সম্পর্ক রাখো, আমাদের সাথে তোমার সম্পর্ক থাকবে না।”
এই কথাগুলো রিতুর মনকে ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু সে জানে, ভালোবাসা কোনো শর্ত মানে না। সে বুঝেছে রাফির জীবনে সে যদি না থাকে, তবে এই ছেলেটি হয়তো একা হয়ে ভেঙে পড়বে।
শহরের ভিড়ে দুই মানুষ
একদিন দুপুরে শহরের ব্যস্ত রাস্তায় তারা হাঁটছিল। শীতের রোদ নরম, রিতুর কাঁধে শাল জড়ানো। রাফির হাতে মায়ের জন্য ওষুধের ব্যাগ। তারা একসাথে হাঁটলেও তাদের চোখে অদ্ভুত দুঃখ জমে আছে।
“তুমি কেমন আছ?” রিতু হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।
রাফি হেসে বলল, “তোমার সাথে থাকলেই ভালো লাগে।”
রিতু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তার হাতটা ধরল। “তুমি জানো, আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে যাব না, তাই না?”
রাফি তাকিয়ে দেখল রিতুর চোখে অদ্ভুত দৃঢ়তা। সে শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
প্রস্তাব
দিন কয়েক পর রাফি সিদ্ধান্ত নিল, যত ঝড়ই আসুক, সে রিতুর সাথে জীবন কাটাতে চায়। সে জানে এখনো সে কিছুই অর্জন করতে পারেনি, কিন্তু তার ভালোবাসা সত্যি।
এক সন্ধ্যায় সে রিতুকে ফোন করল। “রাতের বৃষ্টিতে নদীর ধারে একটু হাঁটবে আমার সাথে?”
রিতু অবাক হলেও রাজি হলো। তারা নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়াল। বৃষ্টির হালকা ফোঁটা পড়ছে, বাতাসে শীতের ছোঁয়া।
রাফি তার হাত ধরে মৃদু কণ্ঠে বলল, “রিতু, আমি জানি আমি এখনো কিছুই দিতে পারি না। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি, সত্যি ভালোবাসি। তুমি কি আমার সাথে থাকতে চাও?”
রিতুর চোখে পানি জমে উঠল। সে হাসল। “তুমি যদি থাকো, আমি পৃথিবীর সবকিছু ছেড়ে দিতে রাজি।”
রাফি তার হাত শক্ত করে ধরল। এই মুহূর্তটা তাদের জীবনের অন্যতম সেরা স্মৃতি হয়ে রইল।
পরিবারের সাথে যুদ্ধ
কিন্তু এই সুখ বেশিদিন টিকল না। রিতুর পরিবার কঠোর হয়ে উঠল। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিল, “এই সম্পর্ক যদি না ভাঙো, তবে আমাদের বাড়িতে তোমার জায়গা থাকবে না।”
রিতু ভেতর থেকে কেঁপে উঠল। সে মায়ের চোখের জল দেখল, বাবার কঠিন মুখ দেখল। কিন্তু সে জানে, রাফি ছাড়া তার জীবন শূন্য।
সে রাফিকে ফোন করে সব বলল। রাফি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তুমি যদি চাও, আমি দূরে সরে যাব। আমি চাই না তুমি পরিবার হারাও।”
রিতুর কণ্ঠ কেঁপে উঠল, “না, আমি তোমাকে ছাড়ব না।”
নিজেদের পথ বেছে নেওয়া
রিতু সিদ্ধান্ত নিল সে নিজের জীবন নিজের মতো বাঁচবে। সে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করবে, রাফি তার মায়ের চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে। হয়তো শুরুটা কঠিন হবে, কিন্তু তারা একসাথে থাকলে সব সম্ভব।
এই সাহসী সিদ্ধান্ত রাফিকে অবাক করে দিল। সে বুঝল, সত্যিকারের ভালোবাসা কখনো ভয় পায় না।
নতুন জীবন
বছর দুয়েক কেটে গেল। রাফি চাকরি পেল, মায়ের চিকিৎসাও অনেকটা এগিয়েছে। রিতুও নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেছে। তারা ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে একসাথে থাকে।
হয়তো এই জীবনটা বিলাসবহুল নয়, কিন্তু তাদের ভালোবাসার উষ্ণতায় ঘরটা সবসময় ভরা থাকে।
শেষ বৃষ্টির গল্প
একদিন সন্ধ্যায় বৃষ্টি নামল। রাফি বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিল। রিতু এসে তার কাঁধে মাথা রাখল।
“মনে আছে, এই বৃষ্টিতেই আমরা প্রথম একে অপরকে ভালবাসার কথা বলেছিলাম?” রিতু হাসল।
রাফি তার হাত ধরল। “হ্যাঁ। সেই বৃষ্টি আজও আছে, সেই ভালোবাসাও।”
বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে তারা দাঁড়িয়ে থাকল। জীবনের সব কষ্ট যেন এই মুহূর্তে দূরে সরে গেছে।
গল্পের সমাপ্তি
ভালোবাসা মানে শুধু সুখের মুহূর্ত নয়, ভালোবাসা মানে ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা। রাফি আর রিতুর ভালোবাসা সেই প্রমাণ। তারা শিখেছে, পৃথিবী যতই কঠিন হোক, যদি দুইজন মানুষ সত্যিকারের ভালোবাসে, তবে কোনো বাধাই তাদের আলাদা করতে পারে না।
— সমাপ্ত —